একটি সত্যি গাছের গল্প
অমিতাভ দাস
ছাদে এসে ইজিচেয়ার পেতে বসে আছে জিষ্ণু। মধ্যবয়স। বিকেলেই
কাজ থেকে ফিরে আসে সে। সন্ধ্যায় গাছে জল দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বেশ কিছুটা সময় সে
ছাদে কাটায়। কখনো পায়চারি করে। কখনো বসে থাকে। ছেলেবেলার
কথা ভাবে। আকাশে বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ। খুব ভালো লাগে জিষ্ণুর। মাধবীলতার গন্ধ,
বেল অথবা গন্ধরাজের গন্ধ তার মন ভালো করে দেয়। আজো সে তৃপ্তিতে চায়ে চুমুক দেয়।
আমগাছটায় এবার অনেক আম হয়েছে। এখন অবিশ্যি ছোট। হাওয়া দিলে দু-একটা আম খসে পড়ে গাছ থেকে। জিষ্ণুর মনে পড়ে ঠাকুরদার কথা। বছর ষাট আগে ঠাকুরদা রথের মেলা থেকে চারা এনে এই গাছ লাগিয়েছিলেন। তখন ছিল ওদের একান্নবর্তী পরিবার। পরে ঠাকুরদা এবং ঠাকুরমার মৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগ হল। হাড়ি আলাদা হল। আমগাছটা জিষ্ণুদের ভাগে এসে পড়ল।
মনে পড়ে জিষ্ণুর একটা সময় এই গাছটায় আম হত না। জিষ্ণু অনেকবার কাটতে বলেছিল গাছটা। ওর
বাবা কাটতে দেননি। একবার কে যেন সিঁদুর
মাখানো একটা গজাল পুঁতেছিল গাছটার শেকড়ে। তখন এক তান্ত্রিক গাছটা কেটে ফেলতে বলেছিল। না হলে খুব ক্ষতি হবে ওদের পরিবারে। জিষ্ণুর
বাবা কেন যেন গাছটি কাটতে দেননি। অনেক অশান্তি হয়েছিল বাড়িতে।
বাবা চলে গেলে পর আবার কয়েক বছর গাছে আম ফলেছিল।
তবে সে
স্বাদ আর
নেই। আম পাকলেই পোকা লেগে যাচ্ছিল। কথা হল কেটে ফেলা হবে। অকারণ পাতা পড়ে থাকে। উঠোনটা নোংরা হয়। জিষ্ণুর
মা বললে,
'তাতে কি--
বাড়িটা তো
অনেক ছায়া পায়--ঠান্ডা থাকে। কাটিস না খোকা, রেখে দে...তোর বাবা চাইতেন গাছটা থাকুক।' ফলে গাছটা কাটা গেল না ওর
মায়ের জন্যেই।
কয়েক বছর হল মা-ও আর নেই। জিষ্ণু একা। আর গাছ কাটার কথা মনেও আসে না তার। আছে থাক। এখন গাছটাকে ওর আপন মনে হয়। এই তো এ
বছর কত
আম হয়েছে। পাড়ার লোকেরা কুড়িয়ে নিয়ে যায়।
এখন ছাদে হেলে পড়েছে গাছটা। বড় মায়াময় মনে হয় রাতের বেলা। দিনের বেলা হরেকরকম পাখি আসে।
এখন, এই বুদ্ধপূর্ণিমার দুধসাদা জ্যোৎস্নায় আমগাছটা ধীরে ধীরে জিষ্ণুর খুব কাছে চলে আসছে। কানে কানে কথা বলছে। যেন এখনি সেটা মানুষ হয়ে উঠে দাঁড়াবে ওর টি-টেবিলের সামনে।
জিষ্ণুর
চোখ জ্বালা করে। সে
চোখ বুজে ফেলে...